শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

কবি চন্দ্রশিলা ছন্দার পাঠ প্রতিক্রিয়া

"জার্নি ফ্রম গ্রামীনফোন টু আমাজন" : ধারাবাহিকতার বাইরে বরিষ ধারা

বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ৮, ২০২১
"জার্নি ফ্রম গ্রামীনফোন টু আমাজন" : ধারাবাহিকতার বাইরে বরিষ ধারা

চন্দ্রশিলা ছন্দা, ঢাকা :

ধারাবাহিকতার বাইরে বরিষ ধারা 

বইটির নাম "জার্নি ফ্রম গ্রামীনফোন টু আমাজন"

বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়। বইটির নাম পড়লেই কিছুটা অনুমান করা যায় এর বিষয়বস্তু কি বা কেমন হতে পারে।  কিন্তু আপনি যদি বইটি সম্পর্কে পুরো ধারণা করেই বসেন তাহলে বলবো ভুল করছেন। 

হ্যাঁ, বইটির লেখক গ্রামীণফোনের মত বিশাল একটি কর্পোরেট কোম্পানির উচ্চ পদস্থ সার্ভিসহোল্ডার ছিলেন, যিনি বর্তমানে পৃথিবী খ্যাত আমাজন কোম্পানিতে কর্মরত।

বইটির নাম পড়ে আমরা যদি ধরেই নিই যে,  রোজনামচার মত তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা লিখেছেন। আর সাদামাটা এমন ভাবনায় অযত্নে রেখে দেই বুক সেইলফে। তবে সত্যি অন্যায় করা হবে নিজের সাথে। কেউ কেউ ভাবতে পারেন, গ্রামীণফোন বা আমাজন কোম্পানি সম্পর্কে আমার জেনে কি লাভ? কিংবা কারো অভিজ্ঞতা পড়েই বা আমি কি করবো? তাহলে বলবো, এই ভাবনাগুলো নেহায়াতই বই ক্রেতার ক্ষুদ্রতা। কিংবা বলতে পারি আপনি প্রকৃত পাঠক নন। সৌখিন বই ক্রেতা। সত্যিকারের পাঠকেরা বই পড়েন অব্যাক্ত এক তৃষ্ণা নিয়ে। সেই তৃষ্ণায় পাঠক এতটাই ডুবে যান যে, তিনি সেখানে খুঁজে পান তার মত করে ভালোলাগার অফুরন্ত ভান্ডার।

সত্যি কথা বলতে কী, যেখানে অনেকের ভাবনার শেষ। সেখানে আমার শুরু হওয়ার একটা তৃষ্ণা কাজ করে। দেখি তো কী আছে এর মাঝে? আর আমি বলবো, আমি মোটেও ক্লান্ত নই। বরং এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় যে চমৎকার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রকাশ, তারই নির্যাস আমি নিংড়ে নিতে পেরেছি। 

বুঝেছি একটি ছোট্ট চারা কী করে হয়ে ওঠে বৃক্ষ।  কী করে হয় বিশাল এক মহীরুহ তারই প্রকাশ "জার্নি ফ্রম গ্রামীণফোন টু আমাজন।" বইটির পাতায় পাতায় লুকিয়ে আছে অসম্ভব ভালো লাগার মত গল্প। জীবনের প্রথম মোবাইল ফোনে কথা বলার শিহরণ। যা এখনকার সময়ে নোট করার মত কোন সাবজেক্টই নয়! কিন্তু ১৯৯৭-৯৮ এ বাংলাদেশে আসা গুটিকয়েক মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর অনুভবকে লেখক চমৎকার রসাত্মকভাবে চির অম্লান করে রেখেছেন এইখানে। "শাপলার সাথে কথা বললাম। কেমন করে কাজ করে এই টেকনোলজি! এইরকম জাদুর যন্ত্র আমিও একটা পাবো, এযে স্বপ্নেও কোনদিন ভাবিনি!" লেখক আনোয়ার এমডি হোসেন এই কথাগুলোর মধ্যে দিয়ে একটি সময়কে বেধে রেখেছেন নিপুণভাবে। যে সময়টি এখন ইতিহাস। 

এ ছাড়াও সাধারণ কাস্টমার কেমন হতে পারে সেই সব ধারণাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অকল্পনীয় সব কাহিনিও জানা হয় এই বইতে। আসলে যে কোন বড় কাজ ছোটভাবে শুরু হলেও কঠোর মেধা আর সংগ্রামের মাধ্যমেই তা সফল সার্থক হয়ে ওঠে। গ্রামীণফোনের শুরুর দিকে লেখক তিন সেকেন্ড পালস বা ফ্রি মিনিটের একটা উদাহরণ খুবই সাবলীলভাবে এবং প্রাসঙ্গিকভাবেই বর্ণনা করেছেন। যা পড়ে আমি সত্যিই হতবাক হয়েছি! যার উদ্ধৃতি না টেনে পারছি না। 

"প্রথম কলঃ আমি আনোয়ার বলছি। 

দ্বিতীয় কলঃ তুমি কেমন আছো?

তৃতীয় কলঃ বাসার সবাই কেমন আছে? 

চতুর্থ কলঃ কাল তুমি অমুক জায়গায় আসতে পারবে?.......

এইভাবে শত শত হাজার হাজার কল হচ্ছে, কিন্তু সবগুলোর সময় তিন সেকেন্ড! বা তার কম। কোম্পানির নেট ইনকাম শূন্য!" তার মানে মানুষ ফ্রী তিন সেকেন্ডের সুযোগটিকে কী অবাক করা কৌশলে ব্যবহার করেছে! "ফ্রী পাইলে বাঙালি আলকাতরা খাই" শুনেছি। ফ্রি পেলে বাঙালি একটা কোম্পানির কী পরিমাণ ভরাডুবি করাতে পারে এই উদাহরণ তার শ্রেষ্ঠ প্রমাণ।



এই যে মানুষে মানুষে ভিন্নতা, শত চরিত্রের মানুষ সম্পর্কে জানতে পারা এই লেখনীর মাধ্যমে, সেটাই বা কম কী? তাছাড়াও বইটি শুধু কিছু অভিজ্ঞতার ঝুলি নয়, লেখার ভাঁজে ভাঁজে প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেড়ানোর চমৎকার নৈসর্গিক বর্ননা। উঠে এসেছে সোনা মসজিদে ঘুমিয়ে থাকা ১৯৭১ এর বীর যোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের ঘুমিয়ে থাকা থেকে সোমেশ্বর নদী। আছে দেশ প্রেম প্রসঙ্গে অপ্রসঙ্গে। যেমন, "শুধু প্রফেশনাল কারণেই নয়, জাতীয় ক্রিকেটারদের প্রতি ভালোবাসাও একটা কারণ। তাঁরাই প্রথম দেশেকে এত বড় সম্মান এনে দিয়েছেন।" 

আসলে যার যতখানি মর্যাদা তাকে ততখানি দিতে পারার মধ্যেই মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে। আমি মনেকরি, দেশপ্রেম মানে তো তাই, স্বজাতির প্রতি পক্ষপাত, যথাযোগ্য সম্মান দেয়া। এবং বিদেশের মাটিতেও দেশের ইতিহাস তুলে ধরা কিংবা দেশের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া। যেমন লেখক তাঁর বর্তমান আবাস পেনসিলভনিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্মরণ করেছেন, "আমাদের গর্বের জাতীয় সংসদের আর্কিটেক্ট লুই আ কান এই ফিলাডেলফিয়ার বাসিন্দা ছিলেন"। কী এক অদৃশ্য সুতোয় যেন মালা গেঁথে ফেলেছেন বাংলাদেশ আর পেনসিলভানিয়ার। 

এর বাইরেও আমরা পেয়েছি আমেরিকার কিছু কিছু ইতিহাস কিছু কিছু পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে। আমিষ নামের একদল মাইগ্রেট মানুষের জীবনধারার কথাও উঠে এসেছে। যা যে কাউকে ছুঁয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। 

মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বর্ণীল সময়,ভাবনা, দীর্ঘতা,বৈচিত্র্যতা,অভিজ্ঞতা আমার কাছে এক-একটি উপন্যাস। যা কেউ লিখতে পারে, কেউ পারে না। যা কখনো পঠিত হয়, কখনো হয় না। কিন্তু লেখক আনোয়ার এমডি হোসেইনের জীবন বড় বেশি বৈচিত্র্যময়। বলা যায় ভীষণই সিনেমাটিক। বইটি পড়তে পাড়তে তাই বার বার ধাক্কা খেতে হয়েছে! তাঁর লাইসেন্স করা অস্ত্র ছিল বলেই কি ডাকাতের হাতে পড়া? সেদিন যদি অস্ত্রটা না থাকতো, তাহলে হয়তো আরও সব হতোভাগ্যদের মত শেষ হয়ে যেতে পারতো লেখকের জীবন এবং পরিবারের আর সবার  জীবনগুলো। কিন্তু না, নায়কের মত পুরো পরিবারকে রক্ষা করেছেন তিনি বুদ্ধি এবং সাহসীকতার মাধ্যমে? কী মারাত্মক ড্রামাটিক! 

নাকি তিনি কখনো লেখক হয়ে উঠবেন বলেই তাঁর জীবন এতোটা ঘটনাবহুল? কিন্তু সব লেখকের জীবন তো এতোটা  সিনেমাটিক নয়। কাকতালীয় হলেও তাঁর জীবনে এসেছে আজিজ মোহাম্মদ ভাই! সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বড় ছেলে তারেক জিয়া! এসেছেন স্টার ক্রিকেটারেরা থেকে ব্রিগেডিয়ার কিংবা সেনাপ্রধান! সবই আসলে তার লেখক হয়ে ওঠার জন্য হয়তো পরমেশ্বরের পূর্ব পরিকল্পিত রসদ ছিল।

পাশাপাশি উপস্থিত বুদ্ধিমত্বা, চারিত্রিক দৃঢ়তা না থাকলে সবরকম পরিস্থিতিকে সামাল দিতে সবাই পারেন না। তেমনি ঘটনাবহুল জীবন হলেই সবাই কিন্তু লেখক হয়ে ওঠেন না। লেখক হতে হলে জীবন ঘেঁষা হতে হয়। জীবনের রূপ,রস,ঘ্রাণ নিতে জানতে হয়। লেখনীতে সারল্য এবং সাবলীলতা থাকতে হয়। যার প্রতিটিই আনোয়ারের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর গদ্যের হাত এতোটাই পাকা যেন সে জানে কোথায় তাকে বাঁক নিতে হবে। কীভাবে গতি ধরে এগুতে হবে। তাই দেখেছি লেখার কোথাও গতি হারিয়ে যায়নি। কোথাও মনে হয়নি এগুলো অপ্রাসঙ্গিক। কিংবা এই বইটি তার প্রথম লেখা বই! যেন সে জানেই, কীভাবে পাঠকের তৃষ্ণাকে চাউর করতে হয়। জিইয়ে রাখতে হয় আগ্রহকে। সত্যি বলতে কি, এমন আকর্ষণ না থাকলে পাঠককের চঞ্চল হৃদয়কে পাঠে ধরে রাখা খুবই দুঃসাধ্য। কিন্তু অসম্ভব বৈচিত্র্যময়তায় এগিয়ে চলা ১৪১ পৃষ্ঠার এই বইটি পড়ে শেষ করে ফেলা যায় এক নিশ্বাসেই।

পরিশেষে লেখকের মোবাইল টেকনোলজি কথার জের ধরে বলতে হয়, ফেসবুকের মত টেকনোলজি যেমন আমাদের একদিকে ক্ষতি করেছে, তেমন সৃষ্টি করেছে অসংখ্য কবি,সাহিত্যিকও। করোনা পরিস্থিতি অসংখ্য মূল্যবান জীবন কেড়ে নিয়েছে। আপনজন হারাচ্ছি আমরা প্রতিনিয়ত। পুরো বিশ্বকে অচল স্থবির করার ফাঁকে ফাঁকে যেন ধ্বংসের মাঝে সৃষ্টি কর চলেছে কিছু সৃজনশীলতা। আর এই সৃজনশীলতার সাথে থেকেই এখনো বেঁচে থাকা এই আমাদের উচিত মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা। মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা করা। দুর্বিষহ লকডাউনের সময়গুলিকে সুন্দর সময়ে পরিনত করা। আর সেই পরিচর্যার কিছুটা আমরা করতে পারি বই পড়ে। বইয়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়ে। হাসিখুশি থেকে।

আমরা বড়রা যারা বিভিন্ন কারণে বা সময়ে বই কিনি। তারা যদি বাসায় এসে না পড়ি তবে বাড়িতে বই পড়ার চর্চাটা তৈরি হবে না। তাই বলবো সংসারের শত কাজের মাঝে নিজেকে একঘন্টা সময় দিন। বই পড়ুন। ভালো সময়ের সাথে থাকুন। 

প্রতিটি মানুষের জীবনে অনিবার্য প্রেমপ্রীতি, বিরহ,দাম্পত্য কিংবা থ্রিলারের বাইরেও যে জীবন গল্প হয়ে উঠতে পারে, তার স্বাদ মিলে জার্নি ফ্রম গ্রামীণফোন টু আমাজন বইটিতে। গতানুগতিক লেখার বাইরেও যে লেখার সাহস লেখক  আনোয়ার এমডি হোসেইন করেছেন, এজন্য তাঁকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। আর এমন আরও ভালো ভালো লেখার প্রত্যাশ্যা করি। প্রত্যাশা করি বইটির বহুল প্রচার এবং পঠনপাঠন। ধারাবাহিকতার বাইরে বরিষ ধারার মধুর অপেক্ষায় থাকবো। আশা করবো গতিময় জীবনের গল্পগুলো উঠে আসুক এমন করে, বারংবার... সাদা কাগজের পৃষ্ঠা ভরে।

চমৎকার এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে ঐতিহ্য Oitijjhya থেকে এবং রকমারি ডটকম এ অর্ডার করে পেতে পারেন বাংলাদেশের যে কোন প্রান্তে বসে। মূল্য মাত্র ২৭০/- টাকা। বইটির প্রচ্ছদে আছেন ধ্রুব এষ

চন্দ্রশিলা ছন্দা 
ঢাকা। 
৫-৪-২০২১

সময় জার্নাল/ইএইচ


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল